সংবাদ শিরোনাম
লোডিং...
Menu

Sunday, 15 December 2024

এক ভাগ্যবতী মা (কিশোর বালকের যুদ্ধের গল্প)

নিঝুম নিস্তব্দ রজনী । আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। ঊর্ধ্বলোকের বাতায়ন খুলে তারকা রাজি মিটমিট করে হাসছে। মেঘমালা ডানা মেলে উড়ে চলে যাচ্ছে দূরে, বহু দূরে, অজানালোকে। স্বর্গীয় সুষমায় সিক্ত পবিত্র মদীনা নগরী তখন ঘুমে সম্পূর্ণ অচেতন । ক্রমে রাত গড়িয়ে সুবহে সাদিক হল ।
 মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মুসলিম নর-নারীরা সালাতে ফজর আদায় করল। সকালের সোনালী রবির আলোকচ্ছটায় পূর্বাকাশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল । রাতের আধার এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। লোকজন নামায শেষে তেলাওয়াত অযীফা নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক এমন সময় আবছা
 অন্ধকারের বুক চিরে একটি সুউচ্চ কন্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ল। মদীনার রাস্তাঘাট, মাঠ-ময়দান, অলিগলিসহ সকল স্থানেই পৌঁছল- হে মুসলিম মুজাহিদরা! হে রাসূলের জানবাজ সাহাবীরা! পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের নাম-নিশানা চিরতরে মুছে ফেলার জন্য সমস্ত কুফুরী শক্তি একত্রিত হয়েছে। বসে থাকার সুযোগ নেই ৷ এক্ষনি জিহাদের জন্য বেরিয়ে পড়। হযরত বেলাল (রা.) এর এ আচানক আহবানে অচেতন মদীনা নগরী শিহরিয়ে উঠল। প্রাণচাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল প্রতিটি ঘরে ঘরে। জিহাদে শরীক হয়ে শহীদ কিংবা গাজী হওয়ার এক দুনির্বার আকাংখা সকলের মাঝেই তীব্র রূপ ধারণ করল । এক বিধবা মহিলা। জীর্ণ কুটিরে স্বীয় পুত্রকে বুকে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হযরত বিলাল (রা.)-এর বুলন্দ আওয়াজ কর্ণ কুহরে পৌঁছতেই তার নিদ্র৷ যেন শত সহস্র মাইল দূরে পালিয়ে যায় । জিহাদের আহবানে তার হৃদয়টা ছ্যাৎ করে উঠে। গরম ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু মনের অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে।

 হৃদয় কন্দরে ভেসে উঠে প্রিয়তম স্বামীর অন্তিম মুহূর্তের স্মৃতি বিজড়িত ঘটনাগুলো। মনে পড়ে ঐ সময়ের কথা, যখন তিনি স্বামীর হস্তে তুলে দিচ্ছিলেন চকচকে শানিত তরবারী, আর নিজ হাতে পড়িয়ে দিচ্ছিলেন লৌহবর্ম । তারপর অশ্বের পদাঘাতে ধুলিঝড় উড়িয়ে তিনি চির বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বদর প্রান্তরে। কিন্তু তারপর……..? তারপর তিনি ফিরে এসেছিলেন শহীদের খুন রাঙ্গা আবরণে । অধরে লেগেছিল জান্নাতী হাসির অপূর্ব ঝলক। প্রতিটি রক্ত কণিকা থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল বেহেশতী খুশবু । শহীদের অমীয় সুধা পান করে তিনি আজ দূরে, বহু দূরে। জান্নাতের মনোরম উদ্যানে । কিন্তু আমি? আমি বুঝি চির বিরহিনী, চির দুঃখিনী। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কল্পনার সাগরে
 সন্তরণের পর তার চক্ষুদ্বয়ে নামল অশ্রুর বান। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। মনে মনে আফসোস করে বললেন, হায়! যদি আমার পুত্র সন্তানটি বড় হত, তবে আজ তাকে জিহাদে পাঠিয়ে মুজাহিদের মা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতাম। ফোঁপানো কান্নার সকরুণ সুর আর বাধভাঙ্গা অশ্রুর উষ্ণ পরশে এতিম বালকটির ঘুম ভেঙ্গে গেল। মায়ের চেহারা পানে চেয়ে হতবিহবল হয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল সে। তারপর কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলল, মা! তুমি কাঁদছ? কি হয়েছে তোমার? এতটুকু বলে আবেগের আতিশায্যে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। ওষ্ঠধর কাঁপতে লাগল । শত চেষ্টা করেও আর কিছু বলতে পারল না । মাও ছেলেকে বুকে নিয়ে স্নেহের আবেশে কপালে চুমু খেলেন । গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে স্বস্নেহে মাথার চুলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন- বাবা! আজ ইসলামের বড় দুর্দিন। এই মাত্র জিহাদের আহবান এসেছে মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ থেকে ৷ সমস্ত কাফেররা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। তারা চায় ইসলাম ও মুসলমানদের নাম নিশানা পর্যন্ত মুছে ফেলতে। তোমার আব্বু বেঁচে থাকলে তাকে জিহাদে পাঠাতাম। কিন্তু তিনি তো বেঁচে নেই। আর তুমিও অনেক ছোট । এ দুঃখেই আমি কাঁদছি । বালকটি শান্ত অথচ গভীর কন্ঠে বলল, এজন্য কি কাঁদতে হয় মা ! আমি ছোট বলে আমাকে অবজ্ঞা করবেন না। কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করার হিম্মত আমার আছে। অনুগ্রহ করে এখনই আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে নিয়ে চলুন। তিনি যদি আমাকে জিহাদের জন্য কবুল করেন তবে তো আমাদের মহা সৌভাগ্য। আর বিলম্ব নয়। চলুন, এখনই আমরা রওয়ানা দেই। তার চোখে মুখে প্রাণোচ্ছলতার ছাপ । 
ছেলের কথায় বিধবা মায়ের শুষ্ক ঠোঁটে খেলে গেল এক টুকরো স্বর্গীয় হাসি। তৃষিত হৃদয় কাননে সঞ্চারিত হল উৎফুল্লতায় ভরা শান্তির জোয়ার। আনন্দের হিল্লোল বয়ে চলল সমস্ত দেহ জুড়ে। স্নেহের আতিশয্যে চুমোয় চুমোয় ভরে দিল তার সমস্ত মুখমন্ডল । বাদ ফজর। মসজিদ চত্বরে অবতারণা হয় এক অপূর্ব দৃশ্যের । চারিদিক থেকে প্রবীন মুজাহিদরা সমবেত হয়েছেন। সাথে সাথে রয়েছেন নবীন মুজাহিদরাও। তাদের মুখে স্নিগ্ধ হাসি। বুকে অসীম সাহস। হৃদয়ে উচ্ছসিত উদ্যম। স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজ তাদের সেনাপতি। আল্লাহপাক পরিচালক। সুতরাং তাদের বিজয় রুখবে কে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ আনলেন। শুরু হল বাছাই পর্ব। যারা ছোট, বয়সে কিশোর, তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হল। অত্যন্ত আদর সোহাগ করে, বুঝিয়ে সুজিয়ে। বাছাই পর্ব এখনও শেষ হয়নি। বিধবা মহিলা তার সন্তানকে নিয়ে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হলেন। আশা-নিরাশার দুলায় দুলছেন তিনি। আলো-আধারের এক অপূর্ব মিলন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার মুখাবয়বে। বললেন আবেগ জড়িত কণ্ঠে ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ ছেলেটি আমার জীবনের একমাত্র সম্বল । আমার আর কোন সন্তান নেই। এর পিতা বদরের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমার হৃদয়ের একমাত্র তামান্না, একে আপনি জিহাদে নিবেন। যেন কেয়ামত দিবসে মহান আল্লাহর সামনে কেবল মুজাহিদের স্ত্রী হিসেবেই নয়, মুজাহিদের মা হিসেবে দন্ডায়মান হতে পারি। বিধবা মহিলার কথায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ মন্ডলে মুচকী হাসির একটা বিদ্যুৎ চমক খেলে গেল। মুগ্ধ হলেন সমবেত মুজাহিদরাও। ভাবলেন, ত্যাগের কি অপূর্ব নযীর। বদর যুদ্ধে স্বামী শহীদ হয়েছেন। এখন আবার কলিজার টুকরা একমাত্র সন্তানকে জিহাদের জন্য নিয়ে এসেছেন। দ্বীনের জন্য এ কুরবানী সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে । পিতার শাহাদাতের কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদর করে ছেলেটিকে কাছে টেনে নিলেন। স্নেহার্দ্র হাত মাথায় বুলিয়ে দিলেন। কপালে চুমো খেয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন– তুমি এখনো ছোট, তাই না? আরেকটু বড় হও। তোমাকে
অবশ্যই জেহাদে নেব, কেমন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে ছেলেটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! রান্না করার সময় আম্মুকে দেখেছি, প্রথমে তিনি ছোট ছোট লাকড়ীগুলো চুলোয় আগে দেন৷ আমি চাই, আমাকেও ছোট লাকড়ীর ন্যায় শত্রু পক্ষের সম্মুখে ঢাল হিসেবে সর্বাগ্রে পেশ করবেন । ছেলেটির বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্মিত হলেন। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলেন তার নিষ্পাপ মুখের দিকে।

 একরাশ প্রশান্তিতে ভরে উঠল তার হৃদয়-মন । বললেন বিধবা মহিলাকে লক্ষ্য করে- যাও হে ভাগ্যবর্তী! আল্লাহ তোমার ছেলেকে কবুল করেছেন। তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। তুমি কিয়ামত দিবসে মুজাহিদদের মায়ের কাতারেই থাকবে।আজকের মায়েরা নিজ নিজ কলিজার টুকরা সন্তানকে দ্বীনের জন্য কুরবানী দিতে প্রস্তুত থাকুক- এই হোক এই ঘটনার মূল শিক্ষা।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: